স্প্যাম বক্স
একটার পর একটা নিষিদ্ধ ওয়েবসাইট ঘুরে ক্লান্ত বিরক্ত অভ্রনীলের মনে হল, শেষবার একটা ফেসবুক পোস্ট লিখবে। শেষ যদি একটা দুটো লাইন বেরিয়ে আসে। ও শুনেছে এইরকম চরম মুহূর্তে অনেক শিল্পীই নিজের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি দিয়ে বিদায় জানিয়েছে এই বিশ্বাসঘাতক পৃথিবীকে। ফেসবুক খুলতেই গুচ্ছের নোটিফিকেশন আর মেসেজবক্সে খান তিরিশেক নতুন মেসেজ। এক নিমেষে চোখ বুলিয়ে নিল ও সব ক’টার ওপর। সেই একই ধরনের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি। নতুন কিছু নেই। এরপর খুলল মেসেজ রিকোয়েস্ট বক্স, সব শেষে মেসেঞ্জারের অন্তিম প্রকোষ্ঠ, স্প্যাম বক্স। মানুষ নাকি এমন কিছু লিখে ফেলে যা প্রযুক্তি নিজের কৃত্রিম বুদ্ধিতে নিষিদ্ধ বলে চিহ্নিত করে এই প্রকোষ্ঠে এনে জমা করে। নিষিদ্ধ সব কিছুতেই এখন নীলের কৌতূহলের ছিবড়েরা একটু চাঙ্গা হয়ে ওঠে কিনা। স্ক্রোল করতে করতে একটা বিশেষ মেসেজে নীলের চোখ আটকে গেল।
“দাদা, ভালবাসা নিবেন বাংলাদেশ থেকে।
আপনার কাছে আমি ঋণী। দাদা আপনি না থাকলে আর এ যাত্রা রক্ষা হতো না। আসলে আমি বিশেষ গুছিয়ে লিখতে পারি না, তাই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। দাদা, মাফ করবেন। আমি আসলে এর আগেও বহুবার আপনাকে মেসেজ দিবার চেষ্টা করেছি, সাহসে কুলায়নি। আজ হসপিটালের বেডে শুয়ে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারি নাই। ভুল কিছু লিখলে ক্ষমা করবেন দাদা। আসলে আমার একটা রোগ আছে। গোটা বিশ্ব জানে যে এই রোগ সারে না। যখন প্রথম জানতে পারলাম আমাকে সেই সর্বনাশা রোগে ধরেছে তখন আমারও সমস্ত আশা শেষ হয়ে গেল। জানেন দাদা, মৃত্যু শিয়রে দাঁড়িয়ে থাকলে মনটা কেমন করে? প্রথম প্রথম খুব ভয় করে, তারপর খুব রাগ হয়, একটা সময় সব কেমন অর্থহীন হয়ে যায়। কেমন যেন একটা ঠান্ডা ঠান্ডা প্রশান্তিভাব এসে ধরে। তারপর আবার আচমকা নিজের সব দিয়ে আঁচড়ে কামড়ে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে হয় নিজের এই শরীরটাকে। নিজের সাথে নিজে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত একদিন নেতিয়ে পড়লাম। একসময় আব্বা, আম্মু অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে কিছু টাকা জোগাড় করে আমায় এসে বলল, আমার নাকি চিকিৎসা সম্ভব। কীসব কেমোথেরাপি না কী আছে, কিছু রশ্মি দেবে আমার শরীরে, তাহলেই নাকি দোষগুলো মরে যাবে। তবে একবারে নয় একটু একটু করে। আমার তখন মনের অবস্থা কথায় বোঝানো শক্ত। আনন্দ, উত্তেজনা, ভয়, প্রত্যাশা সব একসাথে। ততদিনে পেটের ব্যথাটা অসহ্য হয়ে উঠেছে। আব্বার সঙ্গে গেলাম আপনাদের কলকাতায়। সেই প্রথম আমার কলকাতা আসা। দাদা আপনি বিরক্ত হচ্ছেন, না? আপনার কি এত সময় আছে এইসব ভুলভাল কাহিনী শোনার? তবু লিখতে ভাল লাগছে, লিখি। কলকাতা কয়েক ক্ষণের জন্য সব ভুলিয়ে দিল। একটা চাপা উত্তেজনা হতো সবসময়। মনে হত এক হলিউড সিনেমার চরিত্র আমি আর আমার আব্বু। সে যাই হোক, আমায় ভর্তি করা হল এক নামকরা হাসপাতালে। নির্দিষ্ট সময় ব্যবধানে দু’বার কেমো রশ্মি আমার শরীরে দেওয়া হল। আপনাকে আর নতুন করে কী বলি দাদা, আপনি নিশ্চয়ই জানেন, এই কেমোথেরাপি কেমন ওষুধ। সারা শরীর যেন জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে, এমন জ্বালা। ধীরে ধীরে আমার চুলও ঝরতে শুরু করল। আব্বু দেখতে এলে আমি চিল্লিয়ে হাসপাতাল মাথায় তুললাম। আব্বুকে বললাম আমি থাকব না এখানে, আমি মরি তাও ভাল। আমি দেশে যাব, আম্মুর কাছে যাব। আমার এই চিকিৎসা দরকার নেই। আব্বুও দেখি কাঁদছে। কিছু বলছে না। আমি বুঝে গেলাম, আব্বুরও আর ক্ষমতা নেই এই অলুক্ষুনে চিকিৎসা দিবার। টাকাপয়সা শেষ হয়ে এসেছে। আমার চিৎকার থেমে গেল, তার মানে, আমি যা চাই তাই হবে। যা চাই, তাই! দাদা সেই রাতেই আমি শেষবার সেই হাসপাতালে শুয়ে আছি, সিলিংয়ের দিকে চেয়ে চোখে ঘুম আসে না। পাশের বেডে এক দাদা ছিলেন। কলকাতার। উনার হয়ত আমার ওপর একটা মায়া জন্মে গেছিল। উনি রাতে আমার সাথে চুপিচুপি অনেক গল্প করলেন। তারপর বললেন ‘ঘুম না এলে সিনেমা বা ভিডিও দেখবে? আমার ফোনে ইউটিউব আছে। আমার কাছে ইয়ারফোনও আছে। চাদরের তলায় ফোন ঢুকিয়ে কানে ইয়ারফোন গুঁজে দেখলে কেউ কিছু বলবে না। আর তাছাড়া বললেও বা কী, আজই তো তোমার এখানে শেষদিন।’ বহুদিন এইসব দেখি নাই। ভালোও লাগেনা, কিন্তু কেন জানি দাদাটার আন্তরিকতা ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছে হল না। ইউটিউব চালালাম। তবে সিনেমা দেখলাম না, অনেকদিন বাংলা গান শোনা হয় না। গানের ভিডিও দেখছিলাম। দেখতে দেখতে আপনি এলেন। আপনার গান এল স্ক্রিনে। প্রথমটা অনেক মিউজিক টিউজিক ছিল অতো বুঝি নাই, কিন্তু তারপর একটার পর একটা, ছাড়তে পারলাম না। সে কি আপনার লেখা গান? না তো, এ তো আমার গান দাদা। এত সহজে এত সুন্দর করে আপনি আমার কথা গুলো লিখলেন কী করে দাদা? আর সুর! আহ, কতকাল আমার এত শান্তি হয় নাই যত শান্তি আপনার গানের সুরে পেলাম দাদা। সেই শুরু। তারপর দেশে ফিরে আপনার গান আমার রোজ রাতের ওষুধ হল। যতই যন্ত্রণা হোক, আপনার গান শুনলে একটু যেন লঘু হয়ে যেত। হয়ত মনের ভুল আমারই। দাদা, আপনি ভাবছেন এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়লেন। সত্যি যদি কখনো আপনাকে সামনে পেতাম, ছাড়তাম না দাদা। আমি খুঁজে দেখেছি আপনার সব মিলে ২৬টা গান আছে ইউটিউবে। সব শুনে ফেলেছি। তবু আমার কম পড়ে নাই। প্রতিবার নতুন করে প্রেমে পড়েছি গান গুলোর। প্রতিবার নতুন মনে হয়েছে। আপনি আর গান না লিখলেও চলে তবে আপনি আরো লিখবেন আমি জানি। আমাদের জন্য আরো নতুন নতুন উপহার দেবেন। আমাদের বাঁচার সঙ্গী হবে সেগুলো। দাদা বড় বেশি বকে ফেলছি, আসলে সামান্য ব্যথাটা বেড়েছে, তবে বেঁচে যাব, মনে হচ্ছে এ যাত্রা বেঁচে যাব। আর যদি নাও বাঁচি, জানব আমার গান গুলো আপনার কলমে আপনার গলায় বেঁচে থাকবে। আপনি তো নিজের গান লেখেন না। আপনি আমাদের গান লেখেন। আল্লার কাছে দোয়া করি আপনার জন্য। ভাল থাকবেন।”
৬ মাস আগে লেখা একটা এইরকম চিঠি, স্রেফ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের দৌলতে স্প্যাম বক্সে পড়ে রইল। অভ্রনীলের দু চোখ বেয়ে জল বেরিয়ে আসছে, বহুকাল পরে। এক রাশ অপরাধবোধ, এক রাশ মুগ্ধতা, এক বুক দ্বন্দ্ব নিয়ে ও ছেলেটির প্রোফাইলে ক্লিক করল। ওর শেষ পোস্ট চার মাস আগের, সেটাও অভ্রনীলের গানের লাইন
‘এখনো অনেক বাঁচা বাকি
শিখিয়ে যাওয়া বাঁচা কী!’
সমাপ্ত