সিনেমা, রং আর ‘তুমি অনন্য’
তখন আমার বয়স কত আর হবে? খুব মেরেকেটে চোদ্দ কি পনেরো! একটার পর একটা ঝকঝকে হিন্দি সিনেমা দেখে সবার মতন আমিও রোমাঞ্চিত পুলকিত হচ্ছি। অকালে পাকছি আর কী! আমরা তো সবাই প্রায় কোনও না কোনও সময় রুপোলী পর্দার সঙ্গে নিজেদের বাস্তব জীবনকে মেলানোর চেষ্টা করেছি। অথচ মেলাবার সময় দেখতাম কিছুতেই ঠিক মিলছে না। সিনেমায় নায়ক নায়িকারা কীরকম সব সময় সব অ্যাংগল থেকেই দেখি সুন্দর দেখতে হয়। মুখে কোনও দাগ নেই, চোখের তলায় কালি নেই, মাথায় একচিলতে টাক নেই, মধ্যপ্রদেশে এতটুকু মেদ নেই। আর সেইসময় তো সবাই ফরসা। একজন দুজন শ্যামবর্ণ চরিত্র দেখলাম মানে সে হয় ভিলেন নয়ত নগণ্য পার্শ্ব চরিত্র। এমনও দেখেছি, সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকেছিল বাদামি রঙের , দু একটা হিট হতে না হতে লে হালুয়া… কীসব ম্যাজিক করে ফরসা হয়ে গেল। তাছাড়া সবসময় ফিটেড ঝকঝকে পোশাক পরিচ্ছদ, পরিপাটি এলাহি বাড়িঘর, প্রেম পেলেই একেবারে ম্যাজিকের মতন সাঁই করে বিদেশ ভ্রমণ… ওরেব্বাস, সিনেমা না তো! ভুতের রাজা দিল বর।
তা সেইসব দেখতাম আর আশেপাশের প্রিয় থেকে প্রিয়তর মানুষগুলোর চেহারা, প্রিয় বাড়িটার, প্রিয় পার্কটার, প্রিয় কোচিং সেন্টারটার চেহারা কিছুই যেন মেলাতে পারতাম না। অথচ তখন থেকেই দেখতে পেতাম আশপাশটায় কত সুন্দর সুন্দর গল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে। একদম সিনেমার মতন। না না … সিনেমার চেয়েও সুন্দর, মিষ্টি আবার সময়বিশেষে ভয়ঙ্কর কঠিন, হৃদয় বিদারক। কখনও থ্রিলার কখনও ড্রামা, কখনও ধাই ধাই অ্যাকশন কখনও শান্ত সমাহিত। কত কত গল্প। কত কত নায়ক নায়িকা। যারা একদম সত্যিকারের মানুষের মতন দেখতে । মিউজিয়ামে মোমের নিখুঁত পুতুলদের মতন না। তারা ভীষণ অরগ্যানিক, ভীষণ জীবন্ত।
সেই সময়ই মনে অলীক একটা ইচ্ছে দানা পাকাচ্ছিল। ছেলেমানুষি ইচ্ছে আর কী! কী না আমিও একদিন সিনেমা বানাব, কিন্তু সেই সিনেমা দেখতে হবে একদম আমাদের চারিপাশটার মতন। উড়ন্ত রোম্যান্টিক হবে কিন্তু নায়ক হবে আমাদের পাড়ার পাবলো দা , নায়িকা হবে ঐ পাড়ার শর্মিষ্ঠা দি, ভিলেন হবে আমাদের স্কুলের ব্রজেন স্যার, হাস্যরস কৌতুকের অভিনয় করবে আমাদের ক্লাবের গুলুদা। আমি এমন সিনেমা দেখাব যেখানে অনায়াসে আমাদের পাড়ার পানদার খোঁড়া ষাঁড়টাকে বাঁচানোর গল্প থাকবে, থাকবে কীভাবে সেই ষাঁড়ের নাম হয়ে গেল শিবানী। থাকবে মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরনোর দিন টেনশন কমাতে আমাদের সকাল থেকে পুকুরে উদ্দাম ঝাপাঝাপির কথা, থাকবে একটাই মন কয়েকশবার ভেঙ্গে যাওয়ার কথা, কত সাইকেল রাইডের কথা, থাকবে ক্যারাম, ক্রিকেট, সরস্বতী পুজো, পিকনিক, সিগারেটে প্রথম টান, প্রথম হাত ধরা …সে কত ঝুরি ঝুরি গল্প! সিনেমার চাইতেও রঙ্গিন সব গল্প।
দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেলাম। সময় এগিয়ে চলল , পর্দার সিনেমা রঙ্গিন থেকে রঙ্গিনতর হতে থাকল, এদিকে আমাদের জীবনটা হয়ে গেল একেবারে সাদাকালো, বস্তাপচা, ম্যাড়ম্যাড়ে। শুধু নম্বর আর নম্বর, অঙ্ক আর অঙ্ক। নম্বরের দৌড়ে পিছিয়ে পড়লে তুমি হেরে গেলে। একটা বয়সের পরে ন্যুনতম অঙ্কের অর্থ রোজগার না করতে পারলে তুমি হেরে গেলে। একে একে সবাই সরে যেতে থাকবে বায়স্কোপের মতন। পড়ে থাকবে তুমি আর তোমার লড়াই। কীসের লড়াই ? না আমায় অর্থ রোজগার করতে হবে। বাকি সব রং … তোলা থাক। সব স্বপ্ন …তোলা থাক। যেদিন সমাজ আমায় সার্টিফিকেট দেবে যে ‘হ্যাঁ আজ থেকে তুমি একজন সফল ব্যক্তি’, সেদিন না হয় তাক থেকে পেড়ে আনা যাবে রং তুলি খাতা, পেড়ে আনা যাবে স্বপ্নগুলোকে।
বুঝেছিলাম যে করে হোক রং বাঁচিয়ে রাখতে হবে আমাকেই। লড়াই করে। গিটার-কীবোর্ড-গান-আঁকা-ভিডিও এদিকে ব্যান্ড-রিহার্সাল-কম্পিটিশন-লাইভ অনুষ্ঠান এইসব কি শুধু সেই তাগিদ থেকেই? কী জানি? তবে এতটুকু জানি, আমি কোনওদিন চাইনি আমার জীবন থেকে রং চলে যাক, আমার জীবন থেকে সিনেমা চলে যাক। তাই সেই রঙের জন্য লড়েছি অনেক। স্বপ্নের জন্য লড়েছি নিজের বহু প্রিয় মানুষের সঙ্গে। প্রচুর হারিয়েছি। অনেক সম্পর্ক, অনেক বন্ধু, নিরাপত্তা, স্বাচ্ছন্দ্য ইত্যাদি।
এতটা পথ পেরিয়ে (না ফসিলসের গান নয় ) এখন এই চল্লিশে এসে বুঝতে পারছি এইগুলোর কোনওটাই কোনও ফলের আশা থেকে আমি করিনি । কে কী মনে রাখবে না রাখবে সেই জন্য আদৌ নয়। করেছি আসল সিনেমাটাকে রোমাঞ্চকর রেখে চালিয়ে নিয়ে যেতে।
আজ ঠিক এইরকম আরেকটা কাজ মুক্তি পাচ্ছে । সিনেমা বানানো তো আর হল না। মিউজিক ভিডিওর অছিলায় ছোট্ট ছোট্ট করে গল্পগুলো বলে যেতে ইচ্ছে করে। সেই যে গল্প গুলোর কথা বলছিলাম শুরুতে। খেয়াল করে দেখবেন ঠিক সেভাবেই তৈরি আমার খুচরো কিংবা একটা জানালা কিংবা চড়ুই পাখিদের গান আর এখন ‘তুমি অনন্য’। ‘তুমি অনন্য’-তে আবার এক জোড়া নায়ক নায়িকাতেই ক্ষান্ত হইনি । এতে আছে আট আট খানা জুটি। আসলে এই ভিডিওতে আমি আমার সেই ছোট্টবেলার ছেলেমানুষি সাধটাই ছোট্ট করে, মিনি করে পুরণ করলাম। জানেন কীভাবে? কারণ এখানে যারা আমার মুখ্য চরিত্র তারা প্রত্যেকে আসলেই তাদের নিজের নিজের জীবনের নায়ক নায়িকা। প্রত্যেকেই ভীষণ ভীষণ সুন্দর। ভীষণ সত্যি, ভীষণ আসল, ভীষণ জীবন্ত। ওদের প্রত্যেকের জীবনের ভুরি ভুরি রঙ্গিন গল্প নিয়ে তো সিনেমা বানানোর ক্ষমতা বা সুযোগ কোনওটাই আমার নেই, তবে কিছু ছোট ছোট মুহূর্ত ধরে রাখলাম এই গানছবিতে। কে বলেছে স্বপ্নের মতন দেখতে ছবি বানাতে গেলে সবসময় বিরাট রূপবান বা রূপবতী নায়ক নায়িকাকে দরকার পড়ে? আমরা নিজেরা কম সুন্দর নই। আসলে ভিতরে রঙটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়, তাহলেই ঠিক সেগুলো সময় মতন বেরিয়ে আসে, ঠিক যেমন এই ভিডিওতে বেরিয়ে এসেছে বলেই আমার বিশ্বাস। আপনারা দেখুন তো? আমি কি কিছু ভুল বলছি?
তবে ভিডিও টা বানানো মোটেই সহজ ছিল না। শুটিং-এর সেদিনের অভিজ্ঞতা লিখতে গেলে আরও একটা সিনেমা হয়ে যাবে জানেন! সে না হয় আরেকদিন লিখব। আপাতত যাদের ধন্যবাদ না দিলে একদম পাপ হয়ে যাবে তাদের এই বেলা ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাখি। প্রথমেই বলব আমার সহধর্মিণীটির কথা। পারমিতা রাজি না হলে এই পুরো কনসেপ্টটাই মাঠে মারা যেত। তারপরেই বলতে হয় রাজদা পিউ-এর কথা … ওরা কিন্তু চিরকালই আমাদের গ্রুপের হিরো হিরোইন। কিন্তু ক্যামেরার সামনে একসঙ্গে এইভাবে এই প্রথম। পিউ তো প্রথম দিন থেকেই বলছিল, ‘তুই আমায় যাই বল, আমি করব, কিন্তু এইটা বলিস না বাপ্পা , আমি পারব না।’ শুরুতে এত অনিচ্ছা প্রকাশ সত্ত্বেও আরও একজোড়া চেনা হিরো হিরোইন যখন রাজি হয়ে গেল তখন পিউকে আরও খানিকটা সেন্টু দিয়ে রাজি করাতে আমায় খুব বেশি বেগ পেতে হয় নি। এবং সেই পরিত্রাতা দ্বিতীয় জুটি হল অম্বালি আর ডোডো ওরফে মহুল। রাজদাদের বা আমাদের সঙ্গে সেই আদিকাল থেকে ওদের বন্ধুত্ব। ওরা আমার যেকোনো কাজেই একডাকে এগিয়ে আসে, চিরকালই। মাঝখানে দীর্ঘদিনের দূরত্ব ঘুঁচিয়ে যে আমরা আবার কাছাকাছি আসতে পেরেছি এটাই তো আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। এরপরেই নাম নিতে হয় আমার ফ্ল্যাটের ভাই বোনেদের । পাশে শামসুন আর শাহনাওয়াজ আর উপরে অন্বেষা আর অভিক। ওরা তো মহা উৎসাহে দিনক্ষণ দেখে জামা কাপড় কেনাকাটি করে প্রস্তুত। কোনওদিন এর আগে এভাবে ক্যামেরা ফেস না করেও ওরা যা পারফর্ম করেছে এক কথায় অনবদ্য… থুড়ি অনন্য। আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই আমার পিয়ানোর ছাত্রী মধুমিতা আর আমার স্কুলজীবনের বন্ধু তথা মধুমিতার বর অরিজিতকে, আমার ডাকে এইভাবে সমস্ত লজ্জা , সংকোচ কাটিয়ে এগিয়ে এসে ব্যাপারটা দারুণ স্পোর্টিংলি করার জন্য। অশেষ ধন্যবাদ নতুন দুই বন্ধু যুগলকে। কী যে মিষ্টি ওরা কী বলব! উশষী – সৈকত এবং সোহিনী- বিশ্ব। আমাদের সঙ্গে প্রথম আলাপ হলেও একবারও মনে হয়নি ওরা অপরিচিত। মনে হচ্ছে সেই কবেকার আলাপ। আমাদের চেয়ে অনেক ছোট বলে তো তুই তুই করেই কথা বলে ফেললাম। ওরা যে প্রাণ ঢেলে দিয়েছে এই ভিডিওতে সেটা অবিস্মরণীয়, সত্যিই অনন্য। সৈকতদের যোগাযোগ দিয়েছিল প্রলয়। আমাদের সবার চেনা, সবার প্রিয় শিল্পী প্রলয় সরকার। সৈকত ওর একদম ছোটবেলার বন্ধু। আর সৈকতের বন্ধু বিশ্ব। এইভাবেই তৈরি হয়েছিল আমাদের প্রেমযুগলের ফৌজ। সেই যুদ্ধে শুট করল (বন্দুক দিয়ে নয়, ক্যামেরা দিয়ে) আমার টিমের অবিচ্ছেদ্য অংশ শিলাজিৎ দাস মহাপাত্র।
এরপর আরও একদিন অতিথি গায়ক হিসেবে ইন্দ্রনীলকে নিয়ে বনে-বাদাড়ে, পুকুর-মাঠে ঘুরে শুটিং সেরে এলাম। সেদিন শিলাজিতের পাশাপাশি ওর বন্ধু কৌস্তভও যোগ দিল আমাদের দলে, ভরা বর্ষায় টলটলে জোড়া পুকুরের উপর দিয়ে উড়িয়ে দিল ওর সাধের ক্যামেরা পাখি। জুড়ে দিলাম সব কিছু। তৈরি হয়ে গেল আরও একটা মিউজিক ভিডিও বা সিনেমা যাই বলুন না কেন, কিন্তু যেটা দেখতে একদম আসল জীবনের মতন। জানিনা এই ভিডিওটা কতজনের মনে ধরবে…কতজন আদৌ দেখবেন এই কাজ, এটা কতটা ‘পারফর্ম’ করবে আজকের ডেটে… তা সে ভালো খারাপ যেরকমই হোক না কেন আমি জানি এই জিনিস একদম আসল, একদম খাঁটি, একদম অনন্য। আর এই ভিডিওতে এমন কিছু জিনিস ধরা থাকল, যেগুলো বুড়ো বয়সে দেখতে দেখতে হয়ত আমাদের মনটা আবার রংজলে ভিজে উঠবে। আমি তো আগেই বলেছি, আমার আসল লড়াই রং বাঁচানোর লড়াই। স্বপ্ন বাঁচানোর লড়াই।
ভালো থাকবেন। সুন্দর থাকবেন। রঙ্গিন থাকবেন।
For more such articles, latest updates, occasional free gifts and much more click below.